চট্টগ্রামের রাউজানের ৪৫ বছর বয়সী প্রবাসী বাংলাদেশি আবদুল হামিদ সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে আবুধাবির ল-সাদর কারাগারে মারা যান। অভিযোগ ছিল, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নেয়ার পর ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে তিনি কারাগারে আছেন।

হামিদের মৃত্যুর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ আলোচনা শুরু হয় যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরেও এখনো বাংলাদেশিরা জেলে কেন? ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় আমিরাত সরকার ১৮৮ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করলেও পরে শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের ফোনালাপের পর তাদের কয়েক দফায় ক্ষমা ও মুক্তি দেওয়া হয় যার মধ্যে অন্তত ৫৪ জনের ইতোমধ্যেই সাজা ঘোষণা করা হয়ে গেছিল। কিন্তু বিগত এক বছরে অন্তত ২৫ জন বাংলাদেশি শ্রমিককে আমিরাতের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী করা হয়েছে—কেউ ২৫ বছরের, কেউ আজীবন সাজায়। ডায়াস্পোরা সংগঠনগুলো বলছে, তারা কয়েক মাস ধরেই এসব প্রবাসী শ্রমিকের মুক্তির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছে। প্রশ্ন আসে, নতুন করে এই গ্রেফতার কেন করা হচ্ছে?

শহিদুল ইসলাম মুন্না, জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণের অভিযোগে দুবাইতে অন্যায়ভাবে সাজাপ্রাপ্ত।

তার দুইটি ছোট সন্তান। বড় ছেলের সঙ্গে দেখা হলেও, ছোট ছেলের বাবাকে দেখার সুযোগ হয়নি। গর্ভবতী স্ত্রী আর বড় ছেলেকে রেখে তিনি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। স্ত্রী-সন্তানের কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন মুন্না, কিন্তু দেশে ফেরার পথে বিমানবন্দর থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী তিন সপ্তাহ তার কোনো খবর পাওয়া যায়নি, পরিবারও জানত না তিনি কোথায় আছেন।

গ্রেপ্তারের সময় তাঁর চার বছরের কষ্টার্জিত উপার্জন ও স্ত্রী-সন্তানের জন্য কেনা সব উপহার জব্দ করা হয়।

তাঁর সন্তানরা আর স্ত্রী এখনও তাঁর অপেক্ষায় আছেন।

— ফিরবো বাড়ি

কেন গ্রেফতার হচ্ছেন জুলাই যোদ্ধারা?

The Dacca এর কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী, কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি জুলাইয়ের প্রবাসী আন্দোলনের ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রবাসীদের নাম-তালিকা তৈরি করে পাঠিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পুলিশের কাছে। পূর্বে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও নতুন তালিকায় যাদের নাম ছিল, তারা ভিসা নবায়ন বা দেশে ফেরার সময় গ্রেপ্তার হয়েছেন। এমনকি পুলিশ আগে কোনো অ্যারেস্ট ওয়ারেন্টের তথ্যও জানায়নি। এছাড়া মানবাধিকার সংগঠন ফিরবো বাড়ি বলছে, ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, আইনজীবীর সাহায্য না পাওয়া ইত্যাদি কারণে প্রবাসী এই বাংলাদেশীরা গ্রেফতার এড়াতে পারেন নি। এছাড়া, মোট কতজন প্রবাসী এই কারণে গ্রেফতার হয়েছেন তার নিশ্চিত সংখ্যাও নেই মানবাধিকার কর্মীদের কাছে। ফিরবো বাড়ি বাংলাদেশে প্রবাসী পরিবারদের সাথে যোগাযোগ করে ২৫ জন কয়েদীর লিস্ট তৈরি করেছে যারা প্রত্যেকেই ২০২৪ সালের অক্টোবর বা তার পরে গ্রেফতার হয়েছেন।

২৫ জন কয়েদীর লিস্ট, যার মধ্যে ২৪ নম্বরে রয়েছেন প্রয়াত আব্দুল হামিদ 

তবে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা মোট কত জনের লিস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের পুলিশকে পাঠিয়েছেন, কতজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হয়েছে তা বিভিন্ন তৎপরতা চালিয়েও জানা যায় নি।

বিভিন্ন সংগঠনের প্রচেষ্টা

এই গ্রেপ্তারের পর থেকে বিষয়টি নিয়ে নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) প্রবাসী শাখা ডায়াস্পোরা অ্যালায়েন্স ও মানবাধিকার সংগঠন ফিরবো বাড়ি। ২০২৫ সালের আগস্ট মাসে ডায়াস্পোরা অ্যালায়েন্স অস্ট্রেলিয়ার সদস্য সালওয়া শামস জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আটক ২৫ জন বাংলাদেশিকে মুক্ত করার জন্য ধারাবাহিক কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে তারা। এর পরপরই এনসিপির গ্লোবাল কোঅর্ডিনেটর (অপারেশনস) তারিক আদনান মুন দেখা করেন লুতফে সিদ্দিকী (প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত) ও মাহফুজ আলমের (অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা) সঙ্গে। এরপর দলটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে।

সবশেষে, আগস্টের ১১ ও ১২ তারিখে এনসিপির একটি প্রতিনিধি দল দুবাইয়ের কনসাল জেনারেল রাশেদুজ্জামান ও আবুধাবির রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় দুবাই ও আবুধাবি অধ্যায়ের নেতারাও যোগ দেন।

এছাড়া ৪ আগস্ট ডায়াস্পোরা অ্যালায়েন্সের একটি সংবাদ সম্মেলনে দুটি দাবি উত্থাপন করা হয়-

  • অবিলম্বে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করতে হবে এবং একটি consular communication channel স্থাপন করা। 
  • দ্রুত সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক ও আইনি উদ্যোগ নিয়ে ২৬ জন বন্দিকে মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। 

মানবাধিকার সংগঠন ফিরবো বাড়ি বলছে, অধিকাংশ আটক শ্রমিকই নিম্নআয়ের, যাদের কোনো অপরাধমূলক রেকর্ড নেই। সংস্থাটির আশঙ্কা, যদি দ্রুত কূটনৈতিক সমাধান না আসে, তাহলে আরও শতাধিক বাংলাদেশি একই পরিণতির শিকার হতে পারেন। তারা ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্বর্তী বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে। 

ফিরবো বাড়ি সংগঠনের বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট চিঠি 

সংযুক্ত আরব আমিরাত সাধারণত বছরে তিনবার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে—ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা এবং ডিসেম্বরের ২ তারিখে জাতীয় দিবস উপলক্ষে। সালওয়া শামস বলেন যে ডিসেম্বর ঘনিয়ে আসায় এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময় কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার জন্য।

তিনি মনে করেন, ডিসেম্বরের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে যদি কূটনৈতিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে শাহিদুল বা হামিদের মতো আরও অনেক নাম হয়তো যোগ হবে সেই নিঃশব্দ তালিকায়—যাদের “অপরাধ” ছিল কেবল নতুন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানানো।

The Dacca ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাংলাদেশ মিশনের সাথে এই বিষয়ে ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করলেও তারা কোন উত্তর দেন নি।

Tagged in:

Analysis, International

Last Update: October 09, 2025