গতকাল ৩০ মে ২০২৫ তারিখ মানবজমিন "যেভাবে বেহাত নগদের শতকোটি টাকা" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জনাব আতিক মোর্শেদ নিজ ক্ষমতাবলে 'নগদ'-এ তার স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা জুঁইকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। পরবর্তীতে আতিক মোর্শেদ আত্মপক্ষ সমর্থন করে ফেসবুকে পোস্ট দেন যেখানে তিনি দাবি করেন যে তার স্ত্রী “স্বীয় মেধা এবং যোগ্যতায়” আবেদন করে এবং নগদ কর্তৃপক্ষ তার স্ত্রীর “পূর্বের অভিজ্ঞতা, মেধা এবং যোগ্যতার মানদণ্ড অনুসরণ করে” চাকরি দেয়।
আতিক মোর্শেদ তার স্ত্রীর যোগ্যতা হিসেবে “গুলশানে একটি স্বনামধন্য ল'ফার্মে” তিন বছর আইনজীবী হিসেবে কাজ করার কথা উল্লেখ করেছেন। আতিক মোর্শদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) নেতা মোল্লা ফারুক আহসানও এমন দাবি করে আতিক মোর্শেদের স্ত্রীর এই পদায়নের পক্ষে সাফাই দিয়েছেন। ফেসবুক পোস্টে তার স্ত্রীর অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত কোন প্রমাণ না দিলেও আতিক মোর্শেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার স্ত্রীর কর্মস্থলের নাম বলেন এবং প্রয়োজনে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
এছাড়া The Dacca’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে জাকিয়া সুলতানা জুঁই যে পদে (Manager - Compliance) চাকরিতে যোগ দিয়েছেন তার সমমানের পদে অতীতে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অন্তত ছয় বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। যেমন দুই মাস আগে লিঙ্কডইনে দেয়া সিনিয়র ম্যানেজার/ম্যানেজার - টেকনোলজি অডিট পদের জন্য দেয়া একটি জব সার্কুলারে (কমেন্টে লিংক সংযুক্ত করা হল) দেখা যায় পদটির জন্য আবেদন করতে আগ্রহী প্রার্থীদের ছয় থেকে আট বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে, তাও ব্যাংক, বীমা বা কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এমন অপর একটি সার্কুলার যেটি তিন মাস আগে প্রকাশ করা হয়েছিল ম্যানেজার/সিনিয়র ম্যানেজার - ডেটা ইঞ্জিনিয়ার পদের জন্য সেখানেও অন্তত ছয় বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় আগ্রহী প্রার্থীদের কাছে।
নগদে সাধারণত সিনিয়র এক্সিকিউটিভ বা এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদের জন্য তিন থেকে চার বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়ে থাকে। এই অবস্থায় কীভাবে একটি আইনি সংস্থায় মাত্র তিন বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আতিক মোর্শেদের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা জুঁই নগদে যোগ দেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এই খাতে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, জাকিয়া সুলতানা জুঁইকে যে পদে (Manager - Compliance) নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার জন্য কোন ধরণের সার্কুলার দেয়া হয়নি। বর্তমানে ডাক বিভাগে কর্মরত আতিক মোর্শেদ তার ফেসবুক পোস্টে স্বীকার করেছেন যে জুঁইয়ের নগদে চাকরি করা Conflict of Interest বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের আওতায় পড়ে। একইসাথে তার দাবি অনুযায়ী নগদ 'ডাক বিভাগ' এর অধীনে ছিল শুধুমাত্র ১১ মে ২০২৫ থেকে ২৭ মে ২০২৫ পর্যন্ত। জাকিয়া সুলতানা জুঁই তার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন ২০ মে ২০২৫ তারিখ। ডাক বিভাগের অধীনে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানে ঠিক এই সময়ের মধ্যেই তার স্ত্রীর নিয়োগে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন যে এভাবে যথোপযুক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করাটা কোন দুর্নীতির আভাস দেয় কিনা।
The Dacca টিমের হাতে জাকিয়া সুলতানা জুঁইয়ের যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে তাতে দেখা যায় যে জুঁইয়ের বেতন ৭৭,১৪৩ টাকা (বেসিক) এবং অ্যালাউয়েন্স সহ ১,৩৫,০০০ টাকা। The Dacca টিম বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আইনজীবীদের থেকে নিশ্চিত করেছে যে মাত্র তিন বছরের অভিজ্ঞতায় এত উচ্চপদে সাধারণত আইনজীবীদের নিয়োগ দেয়া হয় না।
আতিক মোর্শেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন আইন ভঙ্গ হয়নি। একইসাথে তিনি জানান যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ের বাইরে গিয়ে তার স্ত্রীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কিনা এবং আদৌ কোন প্রকার দুর্নীতি হয়েছে কিনা এই ব্যাপারটি নিয়ে তদন্ত করার জন্য ইতোমধ্যেই ডাক বিভাগ থেকে নগদ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত কোন ধরণের সিদ্ধান্তে না পৌঁছানোর জন্য তিনি অনুরোধ করেন।
এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, আতিক মোর্শেদ তার ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন যে তার স্ত্রী বর্তমানে যে পদে আছে সেটি একটি অস্থায়ী পদ। কিন্তু জুঁইয়ের আইডি কার্ডে দেখা যায় উক্ত পদটি স্থায়ী পদ। আতিক মোর্শেদ জানান যে 'প্রোবেশন পিরিয়ড' শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার স্ত্রীর চাকরি অস্থায়ী বিবেচিত হবে। এই সময়ের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতার দিক দিয়ে সকল শর্ত পূরণ করতে পারলেই কেবল চাকরি স্থায়ী হবে। কার্ডে স্থায়ী লিখার কারণ তিনি জানেন না বলে জানান। তার স্ত্রীর অফার লেটারে তিন মাসের 'প্রোবেশন পিরিয়ড' এর কথা উল্লেখ রয়েছে।
উল্লেখ্য, সাবেক ছাত্রদল নেতা আতিক মোর্শেদ ২০২৪ সাথে গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রদল থেকে পদত্যাগ করে বর্তমানে এনসিপি নেতা ও তৎকালীন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। ফেব্রুয়ারি মাসে এনসিপির দায়িত্ব নিতে নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করলে আতিক মোর্শেদ দ্রুততম সময়ে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তায় পরিণত হন। সরকারি ওয়েবসাইটে নিয়োগসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া না গেলে আতিক মোর্শেদের সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং তিনি তার নিয়োগ সংক্রান্ত ডকুমেন্টস প্রদান করেন। ওয়েবসাইটে তথ্য না থাকার বিষয়ে তিনি জানান যে সকল কর্মকর্তার নাম ওয়েবসাইটে থাকে না।
রাজনীতি সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন আতিক মোর্শেদ এখনও নাহিদ ইসলাম ও এনসিপির একাধিক নেতার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। তবে আতিক মোর্শেদ এটি নাকচ করে দিয়ে বলেন যে কোন বিশেষ দল নয়, বরং কর্মসূত্রে এবং পূর্বসম্পর্কের জেরে দলমত নির্বিশেষে সবার সাথে যোগাযোগ বজায় রাখেন তিনি।