বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কঠিন সময়েও যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের কার্যক্রম বজায় রেখেছিল, তার মধ্যে গাজীপুরের তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা টঙ্গী অন্যতম। তবে, দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অভ্যন্তরীণ কোরামের কোন্দলে প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশ ও অগ্রগতি এখন গুরুতর সংকটের মুখে। বিশেষত ২০১৮ সালের পর থেকে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ নিয়ে জটিলতা এবং প্রভাবশালী শিক্ষক সিন্ডিকেটের ভূমিকা ক্যাম্পাসটির স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মাদরাসাটির অভ্যন্তরে শিক্ষকদের অসাধু কোরাম সক্রিয়, অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। আঙুল সবচেয়ে বেশি উঠেছে কোরামের নেতৃত্বে থাকা সহকারী অধ্যাপক নুরুল হক এবং সালমান ফারসির দিকে। সূত্রমতে, এই কোরাম মাদরাসার নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে অধ্যক্ষকে চাপ দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে আসছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি, এই সিন্ডিকেটের সম্মতি ছাড়া ক্যাম্পাসে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হওয়া ‘প্রায় দুঃসাধ্য’। এমনকি শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়ন, আবাসনের সুব্যবস্থা এবং শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য বাসের ব্যবস্থা সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আশ্বাসও এই সিন্ডিকেটের বাধার কারণে আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া, প্রতি বছর ‘খেলার মাঠ উন্নয়ন বাবদ’ ফি নেওয়া হলেও মাঠ খেলার উপযোগী না থাকা এবং অন্যান্য ‘ভুতুড়ে খরচ’ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে এই সিন্ডিকেটের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক শিক্ষার্থী।
আন্দোলন ও শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থী মারধর
গত ১৮ নভেম্বর, মঙ্গলবার, আলিম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের মূল কারণ ছিল:
১. টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোচিং-এর নামে অতিরিক্ত ২০০০ টাকা আদায়।
২. কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই পরীক্ষা ফি ৫০ টাকা বৃদ্ধি করা।
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে অধ্যক্ষ জানান যে, তিনি ২০০০ টাকা কোচিং ফি নির্ধারণ এবং অতিরিক্ত ৫০ টাকা পরীক্ষা ফি বৃদ্ধির বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলেন। অভিভাবকরা বলছেন, এতেই পরিষ্কার হয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই সিন্ডিকেট কতটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে।
এরপ শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ ও যৌক্তিক আন্দোলন দমনের জন্য রসায়নের শিক্ষক আতিকুর রহমানের নেতৃত্বে একদল শিক্ষক সরাসরি শিক্ষার্থীদের মারধর করে। এই মারধরের ঘটনা ও আহত শিক্ষার্থীদের ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে নেটিজেনরা তীব্র সমালোচনা শুরু করেন।
শিক্ষার্থী মারধরের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সহকারী অধ্যাপক আতিকুর রহমান, প্রভাষক সিবগাতুল্লাহ, এবং সহকারী শিক্ষক কামরুল হাসান-কে বহিষ্কার করে।
এই বহিষ্কারের প্রতিবাদে অসাধু সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে থাকা সালমান ফারসি ও নুরুল হক ক্লাস বর্জনের হুমকি দেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রাইভেট হোস্টেলের এক শিক্ষার্থীর ভাষ্যমতে, অনেক শিক্ষার্থীকে হুমকি দিয়ে সিন্ডিকেটের এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়।
এর পাশাপাশি সিন্ডিকেট সমর্থক একটি পক্ষ শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনাটিকে এখন ‘শিক্ষার্থী দ্বারা শিক্ষক অপদস্তের’ মোড়কে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে ভুক্তভুগীরা অভিযোগ করেছেন।
কোরামের প্রভাবশালী নেতা নুরুল হকের বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অভিযোগ সামনে এসেছে। সূত্রমতে, কিছুদিন পূর্বে হল পরিচালকের দায়িত্ব থেকে বাংলার শিক্ষক আবুল কালাম আজাদকে জোরপূর্বক অপসারণের পেছনে তার হাত ছিল। কোরামের আরেক হর্তাকর্তা সালমান ফারসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির প্রত্যাশায় আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে সনদ নিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে, যা তার দ্বৈত অবস্থান এবং স্বার্থান্বেষী ভূমিকার ইঙ্গিত দেয়।

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে তামীরুল মিল্লাত মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সক্রিয় ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। তবে, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে শিক্ষকদের নির্মম মারধর এবং তারপরও সিন্ডিকেটের ক্ষমতার দাপট দেখে বহু শিক্ষার্থী হতাশ।
মাদরাসাটির ছাত্র সংসদ (টাকসু)-এর নেতারা জানান, "আমরা সবসময় শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির পক্ষে। তবে এই আন্দোলনকে অসাধু এক পক্ষ টাকসু বনাম শিক্ষক আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।"
মাদরাসার অগ্রগতির পথে এই সিন্ডিকেট ব্যবস্থাকে একটি বড় বাধা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট মহল, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা। তাদের মতে, মাদরাসার ইকোসিস্টেমকে বাঁচাতে হলে এই অভ্যন্তরীণ কর্তৃত্ববাদ ব্যবস্থার অবসান জরুরি।
