২৩ জুলাই রাত ৮টা ২৮ মিনিটে ঝুমুর তালুকদার নামের একটি প্রোফাইল থেকে একটি ভিডিও আপলোড করা হয়, যেখানে দাবি করা হয় যে কোন একটি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না পেয়ে 'প্রকাশ্যে রাস্তায় পাইপ দিয়ে এলোপাতাড়ি পে'টাচ্ছে…'। এই ভিডিওটি পরবর্তীতে ২৪ জুলাই "ধরিয়ে দিন! " ক্যাপশনে শেয়ার দেন মীর আহমাদ বিন কাশেম, যিনি ব্যারিস্টার আরমান নামে অধিক পরিচিত। একইসাথে এই ভিডিওর স্ক্রিনশট ব্যবহার করে করা একটি ফটোকার্ডের বরাতে একটি পোস্ট দেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রদলের নেতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মোঃ হাসিবুল ইসলাম। সেখানে ঘটনাটি গাজীপুরের বলে দাবি করা হয়।

এই ভিডিওর ব্যাপারে The Dacca অনুসন্ধান শুরু করলে জানা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য। ভিডিওর শিরোনামে এক তরুণীকে পেটানোর কথা লেখা হলেও ভিডিওতে এমন কিছু দেখা যায় নি। তবে ভিডিওতে একজন ব্যক্তিকে পাইপ দিয়ে পেটানো হয়। নির্যাতকেরা সেই স্থান ত্যাগ করলে তরুণীকে নির্যাতিতের কাছে বসে কাঁদতে ও বিলাপ করতে দেখা যায়।

ঝুমুর তালুকদার নামের প্রোফাইলটি চেক করা হলে দেখা যায় যে এটি পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পক্ষে ক্রমাগত বিভিন্ন প্রোপাগান্ডামূলক পোস্ট করে আসছে।

The Dacca টিম পরবর্তীতে উক্ত ঘটনার আরো কিছু ভিডিও খুঁজে বের করে। "বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবির (Islami Chhatrashibir - Fan)" নামের একটি পেজে আরেকটি অ্যাঙ্গেল থেকে নেয়া একই ঘটনার ভিডিও পাওয়া যায়। পেজটির কার্যক্রম থেকে পেজটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক দ্বারা পরিচালিত বলেই ধারণা করা যায়। সেই পেইজ থেকেও একই দাবি করা হয়। তবে এই ভিডিওতেও মেয়েটিকে আঘাত করার কোন দৃশ্য পাওয়া যায়নি।

ব্যারিস্টার আরমানের পোস্টের কমেন্টে বিএনপি-পন্থী বিভিন্ন ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ক্রমাগত "প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় ছাত্রীকে প্রকাশ্যে কোপালেন ছাত্রলীগ নেতা" শিরোনামের একটি স্ক্রিনশট বারবার স্প্যাম করা হয় এবং বলা হয় যে ২০২০ সালের ছাত্রলীগের অপরাধ ছাত্রদলের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। একই স্ক্রিনশট হাসিবুল ইসলামের পোস্টের কমেন্টেও স্প্যাম করতে দেখা যায়।

তবে The Dacca টিম বিশ্লেষণ করে দেখতে পায় যে ছাত্রদলকে দায়মুক্তি দেয়ার জন্য ব্যবহৃত এই স্ক্রিনশটটিও ভুয়া। একই শিরোনামের যুগান্তরের অন্য একটি নিউজের থাম্বনেইলে ঝুমুর তালুকদারের প্রোফাইলে ব্যবহৃত ভিডিওর একটি ফ্রেম বসিয়ে স্ক্রিনশটটি প্রস্তুত করা হয়েছে। যুগান্তরের প্রকাশিত নিউজের লিংকে গেলে থাম্বনেইলে অন্য একটি ছবি দেখা যায়। ফেসবুক ক্যাশে ভিন্ন থাম্বনেইল আছে কিনা দেখতে যুগান্তরের পেইজে উক্ত নিউজটি খুঁজে বের করলেও আলোচ্য ভিডিওর কোন ফ্রেম সেখানে পাওয়া যায়নি।
বলাই বাহুল্য যে পুরো ভিডিওতে মেয়েটিকে কোনভাবে আঘাত করা হয়নি, তাই এই মেয়েটিকে কোপানোর কোন নিউজ আসলে পাওয়া সম্ভব নয়।

ঝুমুর তালুকদার প্রোফাইলের পোস্টকৃত ভিডিওতে দেখা যায় যে এটি "Ekhon Bangla TV" নামের একটি অনলাইনভিত্তিক নিউজ পেইজ থেকে নেয়া। পরবর্তীতে পেইজটিতে উক্ত ভিডিওটি খুঁজে বের করলে তার ক্যাপশন থেকে জানা যায় যে উক্ত ঘটনাটি বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার ধামুরা বাজার এলাকার। ভিডিওতে আহত ব্যক্তি হলেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল রানা। ২০ লক্ষ টাকা চাঁদা না দেয়ায় এই হামলা করা হয় বলে এখানে দাবি করা হয়। আলোচ্য তরুণী উক্ত সোহেলের কন্যা। একইসাথে পোস্টে স্থানীয় ধামুরা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি সাব্বির ব্যাপারীকে হামলায় নেতৃত্ব প্রদানকারী হিসাবে দাবি করা হয়।

তবে সেখানে বলা হয় যে 'অভিযুক্ত সাব্বিরের বাবা সেলিম ব্যাপারীর দাবি' সাব্বিরের উপর সোহেল ও অন্যান্যরা আগে হামলা করলে 'সাব্বিরের ঘনিষ্ঠজন ছাত্রদলের কর্মীরা' প্রতিশোধবশত সোহেলের উপর হামলা করে।

The Dacca টিম পরবর্তীতে আরেকটি ভিডিও খুঁজে বের করে। ভিডিওটি মূলত আলোচ্য ভিডিওর কিছু সময় আগে ধারণকৃত। এই ভিডিওতে আলোচ্য তরুণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এবং কিছু ব্যক্তিবর্গকে সংঘর্ষে জড়াতে দেখা যায়। "'আমাদের বরিশাল" নামক পেজ থেকে প্রকাশিত এই ভিডিওতে দাবি করা হয় যে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে স্থানীয় আওয়ামী সমর্থক হিসাবে পরিচিত আবু বক্কর ও তার লোকেরা স্থানীয় সেলিম হোসেন ও তার পরিবারের উপর হামলা করে। এতে সেলিম হোসেন, তার ছেলে সাব্বির হোসেন ও অন্যান্যরা আহত হন।

The Dacca-র পক্ষ থেকে স্থানীয় বাসিন্দা ও থানায় যোগাযোগ করলে ঘটনাপ্রবাহ এমন দাঁড়ায় যে জমিজমার বিরোধের জেরে ধামুরা বাজার এলাকায় শোলক ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল রানা সরদার, তার বাবা আবু বক্কর সরদার ও অন্যান্যরা দেশীয় অস্ত্রসহ স্থানীয় সেলিম হোসেন ব্যাপারীর জমিতে গেলে সেলিম হোসেনের বড় ছেলে ধামুরা ডিগ্রি কলেজ শাখা ছাত্রদল সভাপতি সাব্বির হোসেন ব্যাপারী তাদেরকে বাধা দেয়। এসময় তাদের হামলায় সাব্বির হোসেন ব্যাপারী আহত হলে তাকে প্রথমে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।

এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে সাব্বিরের অনুগত অন্যান্যরা ধামুরা বাজার এলাকায় আবু বক্কর ও অন্যান্যদের উপর পাল্টা হামলা করে। এ হামলায় নেতৃত্ব দেয় ধামুরা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মিরাজ। হামলা-পাল্টা হামলায় ব্যাপারটি একটি সংঘর্ষে রূপ নেয়, যেটি The Dacca টিমের কাছে আসা সংঘর্ষের ভিডিওটি ব্যাখ্যা করে। এই সংঘর্ষে সাব্বির হোসেন ব্যাপারীর ছোট ভাই ইমন হোসেন ব্যাপারী, ধামুরা ডিগ্রি কলেজ ছাত্রদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সোহান মৃধা ও কয়েকজন আহত হন। তাদেরকে উজিরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সোহেল রানাকে একা পাকড়াও করতে পারলে সাব্বির ব্যাপারীর লোকেরা তাকে পাইপ দিয়ে বেধড়ক পেটায়, যেটি আলোচ্য ভিডিওতে দেখা যায়। সোহেল রানা সরদার বাদেও তার বাবা আবু বক্কর সরদার ও তার স্ত্রী নেহারু বেগম আহত হয়েছেন। তাদের তিনজনকেই শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

স্থানীয়দের থেকে জানা যায় যে সাব্বির হোসেন ও তার পরিবার ইতোপূর্বেই এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত। এ ব্যাপারে উজিরপুর মডেল থানায় যোগাযোগ করলে জানা যায় যে উভয়পক্ষই এ ঘটনায় একে অপরকে দায়ী করে মামলা করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।

The Dacca-র পক্ষ থেকে সাব্বির হোসেন বা সোহেল রানা কিংবা তাদের পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

Tagged in:

Factcheck

Last Update: August 19, 2025