প্রায় ৬ বছর পর হতে যাচ্ছে ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী অত্যাচারের সমাপ্তের পর এই প্রথম একটি ক্যাম্পাসে নির্বাচন হতে যাচ্ছে যা শুধু ঢাবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয় বরং জাতীয় পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনে প্রার্থীও উল্লেখযোগ্য পরিমানে বেশি। কেন্দ্রের ১৬ পদে মোট প্রার্থী ৪৭০ জন!

সকল প্রার্থীরাই কম বেশি প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে, ইশতেহার দিচ্ছে, জনসংযোগ করছে। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে অনেক প্রার্থীই লাগাতার আলোচনায় থাকলেও একটি বিরাট সংখ্যক প্রার্থী লাইম লাইটের বাহিরে। তাছাড়া এত বেশি সংখ্যক প্রার্থীদের যাচাই বাছাই করা, কোন কোন বাটখারায় প্রার্থীদের বিবেচনা করা উচিত ইত্যাদি কাজ অত্যন্ত ক্লান্তিকর। তবে প্রার্থীদের মধ্যে বিগত বছরগুলোতে ক্যাম্পাসে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন, বাস্তবায়নযোগ্য ইশতেহার, পূর্বের কার্যক্রম ও শিক্ষার্থীদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদির ভিত্তিতে কিছু প্রার্থী আলাদা ভাবে ভোটারদের নজর কেড়েছে।

এ তালিকায় একেবারে শুরুর দিকে আছেন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী উম্মা উসওয়াতুন রাফিয়া (ব্যালট ৩২)। সাধারণত ডাকসুর সদস্য পদ নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও উম্মা উসওয়াতুন রাফিয়াকে নিয়ে আলোচনা ছিলো তার ক্যাম্পেইনের শুরু থেকেই, কেননা তার প্রচারণা ছিলো ভিন্ন ধাঁচের। এর ফলও দেখা যায় তার অনলাইন প্রেজেন্সে। নির্বাচনী প্রচারণা করার আগে রাফিয়ার ফেসবুক ফলোয়ার ৭ হাজার হলেও বর্তমানে তা ৩০ হাজার। ডাকসুর অনেক প্রার্থী তাদের পদের এখতিয়ারের বাহিরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের নজর কাড়ার চেষ্টা করলেও রাফিয়ার ইশতেহার ছিল বেশ বাস্তবমুখী এবং বিচক্ষণ। ইশতেহারে মাত্র দুটি অঙ্গীকারের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে ভোটারদের আশা ভঙ্গ হবেনা। তার ইশতেহারের মধ্যে আছে শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন শৃঙ্খলা কমিটির চলমান তদন্ত কার্যক্রম পাবলিক ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে প্রকাশ করা।

ডাকসুকে কেন্দ্র করে রাফিয়ার অভিনব প্রচারণা

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে অন্যরকমভাবে নজর কেড়েছেন সহ-সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী (ব্যালট নং ৯)। সদ্যবিবাহিত এই ছাত্রনেতা বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) এর পদপ্রাপ্ত নেতা হলেও দলের অনুমতি সাপেক্ষে, স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়েছেন সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে। বাগছাস সমর্থিত প্যানেল থেকে একই পদে দাঁড়িয়েছেন আশরেফা খাতুন।
ভোটারদের কাছে একজন দলীয় নেতা থেকে তাহমীদ নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন তার বহুগুনী প্রতিভার মাধ্যমে। তিনি একাধারে একজন বিতার্কিক, গবেষক ও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন আন্দলনের সংগঠক। এসব গুনের পাশাপাশি ডাকসুতে তার ভিন্নধর্মী প্রচারণা নজর কেড়েছে সবার। প্রার্থীদের মধ্যে তাহমীদ আল মুদ্দাসসীরই প্রথম নিজস্ব ওয়েবসাইট চালু করেন যেখানে তার সম্পর্কিত তথ্য, ব্যালট নম্বর, ইশতেহার, কিভাবে ভোট দেওয়া যায়সহ একজন ভোটারের প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সহজে উপস্থাপন করা। বাকি সবার মত তিনি লিফলেট বিতরণ করলেও তার লিফলেটে আছে কিউআর কোড, যেটা স্ক্যান করলে ভোটাররা তার ওয়েবসাইটে সরাসরি প্রবেশ করে। তাছাড়া তাহমীদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তার বন্ধু-বান্ধবও উল্লেখযোগ্য প্রচারণা চালিয়েছে। যেমন বাগছাস-কে ব্যাঙ্গ করে ফেসবুকে #TheirLoss নামে একটি ক্যাম্পেইন করে, আবার "মোদাচ্ছের পীরের মাজার" নামে স্যাটায়ারিকাল পেইজও চালাচ্ছে। তাহমিদ তার 5D ইশতেহার দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন যেখানে তিনি ক্যাম্পাসের খাদ্য, নিরাপত্তা, গবেষণা ইত্যাদি খাতের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে বাস্তবসম্মত সমাধান দিয়েছেন।

স্বাধারণত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ অরাজনৈতিক হিসাবে পরিচিত হলেও সেখান থেকে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক বিষয়ক পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন আবদুল্লাহ জুবায়ের (ব্যালট নং ১) যিনি জুবায়ের অয়োময় নামেও পরিচিত। অন্যান্য প্রার্থীদের তুলনায় দেড়িতে প্রচারণা শুরু করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলাদা ক্রেইজ তৈরি করতে পেরেছেন তার IBA ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে।
সাধারণত ভাবা হয় যে ঢাবির আইবিএ (ব্যবসায় প্রশাসন) শাখার শিক্ষার্থীরা আগাগোড়া অরাজনৈতিক। তবে সেই স্টেরিওটাইপ ভেঙ্গে দেখাচ্ছেন আব্দুল্লাহ জুবায়ের। তাছাড়া ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক বিষয়ক পদপ্রার্থী হিসেবে তার ইশতেহার নিয়েও পেয়েছেন ব্যাপক সাড়া। সেন্ট্রাল জব ও ইন্টার্নশিপ পোর্টাল চালু করা, অ্যালমনাই নেটওয়ার্ক তৈরি, বছরে দুইবার ক্যারিয়ার এক্সপো আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি ভোটারদের আকর্ষিত করেছে। এছাড়া জুবায়েরকে নিয়ে রয়েছে নানান শিক্ষার্থীবান্ধব অভিজ্ঞতা। তার বন্ধু ইশরাক আহমেদ ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন যে রাইড শেয়ারিং অ্যাপে সার্ভিস নেওয়ার সময়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত ড্রাইভার একজন শিক্ষার্থী জানার পর জুবায়ের নিজ থেকেই তার জন্য টিউশন খুঁজতে থাকে কেননা এতটা কষ্টকর কাজের পর একজনের পড়ালেখা কন্টিনিউ করা খুবই কঠিন।
এসকল অভিজ্ঞতা, নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড, শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা- সব মিলিয়ে কম সময়ের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজেকে চেনাতে পেরেছেন জুবায়ের।

আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী তাসনিম বিন মাহফুজ (ব্যালট ৫) ডাকসুতে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্রভাবে। Dhaka University Model United Nations Association (DUMUNA) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এই শিক্ষার্থী তার হাতের পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে ব্যালট নম্বর ৫ কে ইঙ্গিত করে তার প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার ইশতেহারের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি হলো ইন্সটিটিউট অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজস (IML) কে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে IELTS ও অন্যান্য পরিক্ষার স্বীকৃত পরিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। এছাড়াও গবেষণার ডাটাবেজ তৈরি, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমঝোতা স্মারক (MoU) ইত্যাদি প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ক্যাম্পাসে সাড়া জাগিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী আরেকজন ক্যান্ডিডেট হলেন মোহাম্মদ সাকিব (ব্যালট ১৪) যিনি বাগছাস সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন। ইতোমধ্যেই তিনি বিভিন্ন দেশের ঢাবি অ্যালামনাইদের সাথে যোগাযোগ করে একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। ইতোমধ্যে হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ডসহ বিভিন্ন টপ ইউনিভার্সিটির বর্তমান ও সাবেক ছাত্রদের নিয়ে তার পক্ষে সমর্থন জানানো একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে। তার ইশতেহারে রয়েছে স্কলারশিপের জন্য 'ওয়ান স্টপ এলার্ট সিস্টেম', এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ও রিসার্চ গ্র্যান্ট। তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কারণে সোশাল মিডিয়াতে তিনি ব্যাপক প্রশংসা কুড়াচ্ছেন।

ক্যাম্পাসে মূলত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলেও ব্যতিক্রম হলেন শেখ তানভীর বারী হামিম। সাধারণত দলীয় কিংবা লেজুরভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের নিয়ে ভোটারদের অনীহা থাকলেও ছাত্রদল সমর্থিত বাংলাদেশপন্থী শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (ব্যালট ১৭) পদপ্রার্থী হামিমের ক্ষেত্রে তা ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। ছাত্রদলের পরিচয় ছাড়াও তিনি ক্যাম্পাসে পরিচিত "কমল মেডিকেল ক্যাম্প" এর মাধ্যমে। এছাড়া স্কুলজীবন থেকেই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয়।
ছাত্রদল করলেও হামিম তার দলের সমালোচনা করতে কখনো পিছপা হন নি। গতকাল খুলনার এক স্থানীয় ছাত্রদল নেতা ঢাবির শিক্ষার্থীদের কাছে ভোট চাওয়ার একটি ভিডিও চোখের সামনে আসামাত্রই হামিম নিজে উচ্চ পর্যায়ে কথা বলে সেই নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেন। এমনকি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা ফজলুর রহমানের জুলাই গন-অভ্যুত্থানকে ছোটো করে দেওয়া বক্তব্য দেওয়ারও প্রতিবাদ করেন তিনি। লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের তাদের মাদার সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নজির এখন পর্যন্ত কোনো ডাকসু প্রার্থী দেখাতে পারেন নি বলেই শিক্ষার্থীদের আলাদা সম্মান পাচ্ছে হামিম।
ছাত্রদলের দলীয় ইশতেহারের বাহিরেও হামিম তার ১৭টি প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছেন যা তার ডাকসুরর জন্য তৈরি ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের ধারণা, হামিমের ইশতেহার অন্যান্য প্রার্থীদের ইশতেহারের থেকে আলাদা কারণ তার ইশতেহার বাস্তবায়নযোগ্য।
এছাড়া ডাকসুর অফলাইন ক্যাম্পেইন শেষ হলে ক্যাম্পাস থেকে সব লিফলেট সরিয়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়ে সবার মাঝেই প্রশংসা পাচ্ছেন তিনি।

কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী মিশকাতুল মাশিয়াত (ব্যালট ৭৪) ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রাণী প্রেমিক হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন 'বামজোট' হিসাবে পরিচিত প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেল থেকে। Animal Welfare Team of Dhaka University নামক একটি সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি। সাধারণ কার্যদিবস তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সময়ে বন্ধ থাকলে মাশিয়াত ক্যাম্পাসে এসে কুকুর ও অন্যান্য প্রাণীদের দেখাশোনা করেন। তার এই প্রাণীপ্রেমিক চরিত্র ফুটে উঠেছে তার ইশতেহারেও, যেখানে তিনি ক্যাম্পাসের সকল কুকুরকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্র মিলিয়ে তার মোট ইশতেহার ৯টি।

ক্যাম্পাসের কুকুরদের সাথে মিশকাত

এছাড়াও বিভিন্ন প্যানেলের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীও নজর কেড়েছেন। শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদপ্রার্থী আসিফ আবদুল্লাহ (ব্যালট ৫) এর বন্ধুরা আসিফ আব্দুল্লাহ সমর্থক গোষ্ঠী-প্যারোডি পেজ খুলে প্রচারণা করছেন। ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী আনোয়ার হোসেন (ব্যালট ১) প্রশংসিত হচ্ছেন তার ব্যতিক্রমধর্মী ও হাস্যরসাত্মক ভিডিওর কারণে। এছাড়াও টাকা, লিগাল নোটিশ, স্ট্যাম্প ইত্যাদির আদলে তৈরি করে অনেকে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদপ্রার্থী মোঃ ইব্রাহিম আদল (ব্যালট ১৩) প্রশংসিত হয়েছেন তার এআই জেনারেটেড প্যারোডি ভিডিওর মাধ্যমে।

তবে এসব ইশতেহার কিংবা প্রচারণা আদৌ কতটা প্রভাব ফেলছে ভোটারদের মনে, তা কেবল জানা যাবে ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনের পরেই।

Last Update: September 07, 2025