শেখ মুজিবকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই। শুধুমাত্র একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করতে হবে। সেটা হলো আমরা কেনো ১৫ই আগস্ট উদযাপন করবো?

এক বাক্যে বললে, আমাদের পূর্ব পুরুষদের উপর হয়ে যাওয়া নির্মমতা-নৃশংসতার স্বীকৃতি এবং তার থেকে আজাদীকে মনে রাখতেই আমাদের ১৫ই আগস্ট উদযাপন করতে হবে। 

১৯৭২-৭৫ টাইমলাইন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বা পড়াশোনা করতে গিয়ে কি পেয়েছি না পেয়েছি তার থেকে আমাকে বেশি বিচলিত করেছে সেই জাহেলিয়্যাত নিজ চোখে দেখা প্রবীণ ব্যাক্তিদের জবানবন্দি। আমাদের করা "৭৪ এর দুর্ভিক্ষ" ও "মুজিববাদ মুর্দাবাদ" ইভেন্ট দুটিতে এরকম অনেক মানুষ এসেছিলেন যারা মুজিবের শাসনামল পেয়েছেন। তারা যখন মুজিবের শাসনামল আমাদেরকে বর্ননা করছিলেন তাদের বুকের চাপা কষ্ট ঠিকরে বেড়িয়ে আসছিলো। ১৫ই অগাস্টের ঘটনা বর্ননার সময় তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো। তারা আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের চোখে পানি টলটল করছিলো। তাদের বুক থেকে যেন পাথর নেমেছিলো সেইদিন৷ ঠিক আমাদের ৫ই অগাস্টের মতো। 

শেখ মুজিব তার জীবনে মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করেছেন। পরবর্তীতে করেছেন বাঙালী জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। এই পরিবর্তন কি বা কেন তা গুরুত্বপূর্ণ না। কে কোন মতবাদে বিশ্বাসী তাও গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই মতবাদ মানুষের জন্য কি করেছে। প্রতিটি মতবাদেরই যৌক্তিকতা থাকে৷ তার পিছনে চিন্তা থাকে। কিন্তু সেই মতবাদকে সার্থক করে তার কাজ। মুজিবের আইডোলজি এইদেশের মানুষের উপর নৃশংসতা চালানো ব্যাতিত আর কি করলো? 

হ্যাঁ, শেখ মুজিব ৭১ এর আগে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। সমস্যা হলো তিনি দেশের রাজনীতিতে যা করেছেন তা কি দেশের খেটে খাওয়া মলিন মুখের আপামর জনতার স্বার্থে করেছিলেন?

শেখ মুজিব তো চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব। ইতিহাস বলে নিজের মুখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণটুকু দিতেও তিনি রাজী হননি। ৭২ এ দেশে এসে প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়েই শুরু করেছিলেন ত্রাসের এক রাজত্ব। 

১৯৭৪ এ দেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকে কাউকে জানতে দেয়া হয়নি।  ক্ষমতা হাতে নেয়ার পরে থেকে নিয়মিত লুন্ঠন, শোষন ও সন্ত্রাসে তৈরি হয় মানবতৈরি দুর্ভিক্ষ। যেই দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায় লাখ লাখ বাংলাদেশী। খাবারের অভাবে মৃত্যু, খাবার নিয়ে কাড়াকাড়িতে মৃত্যু, পিতামাতা কর্তৃক সন্তান বিক্রি, সন্তান হত্যা। কোন নির্মমতাই বাকি ছিলোনা সেই দুর্ভিক্ষে। অথচ সেই সময়ে শেখ মুজিব নিয়মিত তার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে ঢাকা ক্লাবে, গণভবনে বা ৩২ নম্বরে পার্টি করতেন। ছেলে শেখ কামালকে বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন সোনার মুকুট। AFP নিউজের একটি রিপোর্ট এখনও দেখা যায়। যেখানে বলা হয়, চরম দুর্ভিক্ষে ফরেইন এইড আসে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের। যা দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশও গঠন করা সম্ভব ছিলো। কিন্তু সেই এইডের হদিস আর পাওয়া যায় না। লঙ্গরখানা তৈরি করে "মুজিব ত্রাণ" নামে শুরু হয় আরেক সার্কাস। সেই সামান্য ত্রাণও মেরে খেয়েছে মুজিবের পোষা বাহিনী। ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে মুজিবকে জিজ্ঞেস করলে মুজিব বলেন "১৫-২০ হাজার মানুষ মারা যাওয়া এমন কিছু না। একটা গোষ্ঠী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।" অথচ তৎকালীন গণকণ্ঠ পত্রিকার বরাতে দেখা যায় শুধুমাত্র রংপুর জেলাতেই খাবারে অভাবে মারা যান ৫০হাজারের বেশি মানুষ। 

মুজিব সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ তার করা মগের মুল্লুকে সেনাবাহিনী যে তাকে সহায়তা দিবে না এটা তিনি জানতেন। তাই নিজের নিরাপত্তার খাতিরে তৈরি করেন মুজিববাহিনী। যা পরবর্তীতে হয় রক্ষীবাহিনী। এই রক্ষীবাহিনী হিটলারের নাৎসি বাহিনী থেকে কোন অংশেই কম ছিলো না। হত্যা, গুম, ধর্ষণ, লুটপাট থেকে শুরু করে এহেন কোন অপকর্ম ছিলো না যা তারা করেনি। গেস্টাপো স্টাইলে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো যুবকদের। যাদের একবার তুলে নিয়ে যেতো রক্ষীবাহিনী তাদের আর হদিস পাওয়া যেত না। বাবার সামনে ছেলেকে হত্যা করে বাবার হাতে কুঠার দিয়ে ছেলের মাথা আলাদা করানো এমনই এক উদাহরণ। গ্রামের পর গ্রাম লুটপাট করতো এরা। গ্রামের মানুষ আতঙ্কে থাকতো কখন রক্ষীবাহিনী পরবে গ্রামে। অথচ এই রক্ষীবাহিনীকে পরবর্তীতে ইনডেমনিটি দেন শেখ মুজিব। সেইসাথে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় হাজার বা লাখ লাখ গুম-খুনের শিকার হওয়া বাংলাদেশী। 

১৯৭৩ এর নির্বাচনের মাধ্যমে এইদেশে ভোটচুরির হাতেখড়ি করেন শেখ মুজিব। গণতন্ত্রকে হত্যা করেন হাজার হাজার জাসদ কর্মী হত্যা করার সাথেই। বিরোধীদলের উপর লেলিয়ে দেন পোষা রক্ষীবাহিনীকে।  বিপ্লব রক্ষা করার নামে গ্রামের পর গ্রাম বিরোধীদলীয় বামপন্থী নেতাকর্মীদের হত্যা করে এই বাহিনী। 

মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে গুম হন অসংখ্য নেতা। নির্বাচনে দাড়ানোর জন্য নির্যাতনের শিকার হন অনেকে। ভোটকেন্দ্র দখলে রাখে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মানুষ ভোট দিতে গেলে তাদের ভোট হয়ে গেছে বলা হয়। এভাবেই তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করেন শেখ মুজিব। 

সারাদশের ডাকাতি, লুটপাট, হত্যা, গুম, নির্যাতনের তদারকি করতো শেখ মুজিবের ভাই শেখ নাসের, ছেলে শেখ কামাল, ভাগ্নে শেখ মনিসহ তার পরিবারের সদস্যরা। 

১৯৭৪ সালে বৈদেশিক চাপে সেনাবাহিনীকে দেশের আইন রক্ষায় নিয়োজিত করেন মুজিব। আর্মি যখনই কোন অপরাধীকে ধরতো তার কিছুক্ষণ পরেই কল আসতো শেখ মুজিবের অফিস থেকে। আর ধর্ষক, ডাকাত, খুনিদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো আর্মি। এভাবে যখন লুটপাটের তদন্তে বেড়িয়ে আসে শেখ নাসের, কামাল, মণির নাম তখনই মেজর নূর, মেজর রাশেদ, মেজর ডালিমদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান শেখ মুজিব। 

শেখ মুজিবের মতামত ছিলো পার্টি চালাতে এগুলো করতেই হবে। আবার তিনিই সিরাজ শিকদারকে হত্যার পর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ঔদ্ধত্যের সাথে বলেছিলেন "কোথায় আজ সিরাজ শিকদার?"

বাকশাল গঠন করেন দেশে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে। সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেন সরকারি কিছু পত্রিকা ছাড়া। ইতিহাস থেকে মুছে যায় দেশের সবচাইতে নির্মম ছয়টি মাস। 

দুর্ভিক্ষে শহীদ হওয়া লাখ লাখ শিশু বা রক্ষীবাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া লাখ লাখ বিপ্লবীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করুন তো, বাংলাদেশের রাজনীতির আর কোন ক্রেডিট আপনি শেখ মুজিবকে দিতে চান। তার হত্যায় আর কোন জগতের শোক আপনি পালন করতে চান?

নাকি দুর্ভিক্ষে বা রক্ষীবাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া বাংলাদেশীরা মুক্তিযুদ্ধের মুজিবীয় চেতনার বলি বলে তাদের নিয়ে কোন শোক বা উচ্চবাচ্য করা যাবেনা?

শেখ মুজিবের ১৯৭২-৭৫ এর শাসনামল নিয়ে লিখতে বসলে কয়েক হাজার উদাহরণ দিয়ে কয়েকটি বই লিখা সম্ভব। হাজারো ঘটনা বর্ননা করা সম্ভব। কিন্তু তা করেও মুজিব নিয়ে বাড়াবাড়ি ঠেকানো সম্ভব কি?

মুয়াম্মার গাদ্দাফী বা এডলফ হিটলারকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বৈরাচার বলা হয়। কিন্তু গাদ্দাফীও দিনশেষে তার দেশের মানুষকে বিভিন্ন জরুরি সেবায় ফ্রি সার্ভিসের ব্যাবস্থা করেছিলেন। হিটলারের নাজিজমের পিছনেও কোনো না কোনো জায়গায় জার্মানির লাভ দেখা যায়। কিন্তু শেখ মুজিবের এই বিশাল হত্যাযজ্ঞ, লুটতন্ত্রের পিছনে তার আত্মতৃপ্তির খায়েশ ছাড়া আর কোন মোটিভ কাজ করেছে? তাহলে কেনো আমরা আজও শেখ মুজিবকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ স্বৈরাচারের বা দুনিয়া শ্রেষ্ঠ ফ্যাসিস্টের সম্মান দেই না?

আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী স্টাব্লিশমেন্টের ভিত্তি ছিলো প্রধানত দুইটি। 

১. মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান।

২. শেখ মুজিবকে খোদা হিসেবে উপস্থাপন। 

এবং শেখ মুজিবের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের কালচারাল ফ্যাসিজম এখনও টিকে আছে। হালের বিভিন্ন চিন্তক আওয়ামী লীগকে তুলনা করেন একটি নফসানিয়্যাতের সাথে বা ধর্মের সাথে। যেই ধর্মের প্রভূ হলেন শেখ মুজিব। এক মিথ্যার পাটাতনে দাঁড় করিয়ে যাকে আমাদের সামনে প্রভু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এই দেশের মানুষের আওয়ামী জাহেলিয়্যাত থেকে মুক্তি লিখা আছে দুইটি পন্থায়। 

১. মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী বয়ানের বাইরে নিয়ে আসা।

২. শেখ মুজিবের মাধ্যমে তৈরি হওয়া আওয়ামী লীগের কালচারাল স্টাব্লিশমেন্ট ধ্বংস করা। 

মুজিববাদকে যেকোনো উপায়েই আমাদের ধ্বংস করতে হবে। কারণ মুজিববাদীতা এমন এক বিষবাষ্প যা দিয়ে নির্দ্বিধায় হাজার হাজার-লাখ লাখ মানুষ হত্যা করা যায়। এর প্রমাণ স্বয়ং শেখ মুজিব আর তার কন্যা শেখ হাসিনার শাসনামল। মুজিববাদই আবরার ফাহাদ, বিশ্বজিৎদের হত্যা করার বৈধতা দেয়। বৈধতা দেয় আয়নাঘর আর হাজার হাজার মানুষ হত্যার। মানুষ হত্যা করে রক্তাক্ত লাশকে বলতে পারে "রঙ মেখে শুয়ে ছিলো।" লাখকোটি টাকা লুটপাট আর পাচারের বৈধতা দেয়। দেশমাতৃকাকে তলাবিহীন ঝুড়ি বানানোর বৈধতা দেয়। 

আর এইজন্যই আমাদের ইতিহাসের লুকানো পাতা থেকে তুলে আনতে হবে জগৎশ্রেষ্ঠ স্বৈরশাসক শেখ মুজিবের অপকর্ম। 

একইসাথে আমাদের মহান বিপ্লবী পূর্বপুরুষ যারা শেখ মুজিবের হাত থেকে এই বাংলাদেশী কওমকে মুক্ত করেছেন তাদের সম্মানের সাথে স্মরণ করতে হবে। ১৫ই  আগস্টকে পালন করতে হবে আমাদের পূর্ব পুরুষদের আজাদী দিবস হিসেবে।

Tagged in:

Feature

Last Update: August 17, 2025